এসএম শহীদুল ইসলাম, সাতক্ষীরা : পাট আমরা নিজেরা চাষ করি। পাটের বীজ বোনা থেকে শুরু করে আগাছা দমন, জাগ দেওয়া, আঁশ ছাড়ানো, রোদে আঁশ শুকানো ও বিক্রি করা পর্যন্ত সব কাজ নিজেরা করি। জোন ধরে (শ্রমিক নিয়ে) পাট চাষ করলে খরচের টাকা উঠবে না। গতবারের চেয়ে এবার পাটের দাম ভালো। পাটের আঁশ ও পাটখড়ি বিক্রি করে এবার খরচ উসুল করে কিছু লাভ হবে। এভাবে পাট চাষের লাভ-লোকসানের কথা বলছিলেন সাতক্ষীরার বকচরা এলাকার কৃষক আকরাম হোসেন ও সুমন সরদার। তারা বলেন, পাটের সোনালী আঁশে এক সময় স্বপ্ন বুনতো কৃষক। কিন্তু প্লাস্টিক ও নাইলনের দাপটে হারিয়ে যেতে বসেছে পাট ও পাটজাত পণ্য। প্লাস্টিক, পলিথিন ও নাইলনের ব্যবহার কমাতে পারলে ফিরবে পাটের সুদিন। পরিবেশ বান্ধব পাটজাত পণ্য ব্যবহারে জনসচেতনতা বাড়াতে সরকারি-বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। পাট এমনই একটি ফসল যা বর্ষা মৌসুমে আমন ধান রোপনের আগে পাওয়া যায়। এতে করে কৃষক কিছুটা বাড়তি আয় করতে পারেন। আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে পাটের অবদান ফুরিয়ে যায়নি।-বলছিলেন কৃষক সুমন সরদার।
কৃষক আকরাম হোসেন বলেন, গত বছর পাটের দাম ছিল প্রতি মণ ১৮০০টাকা। এ বছর প্রতি মণ পাটের দাম ২৫০০টাকা। এতে পাট চাষে আগ্রহ বেড়েছে চাষীর। দাম বাড়লে কী হবে পাট চাষে খরচও বেড়েছে। কেননা পাটবীজ বপনের সময় জমিতে বাড়তি সেচ দিতে হয়। আগাছা দমন করতে হয়। পরিচর্যা করতে হয়। পাট কর্তনের পর জাগ দিতে হয়। আঁশ ছাড়াতে হয়। ছাড়ানো আঁশ রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়। পুরো প্রকিয়া সম্পন্ন করতে খরচ হয় বিঘাপ্রতি কমপক্ষে ১৫-২০ হাজার টাকা।
জেলার সাতক্ষীরা সদর উপজেলার নারানঝজাল গ্রামের পাটচাষী পলাশ হোসেন জানান, অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় চলতি মৌসুমে পাট উৎপাদনে খরচ বেশি হয়েছে। গত বছর বিঘাপ্রতি ১৫-১৬ হাজার টাকার মতো খরচ হলেও চলতি বছর ১৯-২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু সেই হিসাবে পাটের ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।
কৃষক সেলিম হোসেন জানান, এবার তিনি তিন বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন। এতে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, তিন বিঘা জমির যে পাট উৎপাদন হয়েছে তা হয়তো ১৮-২০ মণ হতে পারে। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৬০ হাজার টাকা। পাট বিক্রি করে খরচ উসুল হলেও লাভ থাকবে পাটখড়ি। প্রতি বিঘা জমির পাটখড়ি বিক্রি করে হাজার দশেক টাকা লাভ হতে পারে।
সাতক্ষীরা কলারোয়া উপজেলার কেঁড়াগাছি গ্রামের কৃষক আব্দুস সালাম জানান, চলতি মৌসুমে দেড় বিঘা জমিতে পাট চাষ করেন। কিন্তু অনাবৃষ্টির কারণে এবার পাট চাষে তিনি ব্যাপক দুুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। এতে তার শ্রমিক ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। কিন্তু বর্তমান বাজারে পাটের যে দাম রয়েছে তাতে হতাশায় পড়েছেন কৃষক আব্দুস সালাম।
তিনি বলেন, বিঘাপ্রতি উৎপাদন খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। সেখানে একই জমির পাট বিক্রি করতে হচ্ছে ১৪-১৫ হাজার টাকা। এ কারণে দেড় বিঘা জমির পাট চাষ করে তার ১০-১২ হাজার টাকা লোকসান হতে পারে বলে জানান তিনি।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঝাউডাঙ্গা বাজারের পাট ব্যবসায়ী ও আড়তদার রেজাউল ইসলাম জানান, গত বছর এ সময় যে পাট ৩ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে তা বর্তমান ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের দেশের উৎপাদিত পাটের বেশির ভাগ রফতানি হয়ে থাকে রাশিয়ায়। কিন্তু যুদ্ধের কারণে রাশিয়ায় পাট রফতানি আপাতত বন্ধ থাকায় দাম কমেছে। ফলে চাষীরা লোকসানের মধ্যে পড়েছেন।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, চলতি মৌসুুমে সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলায় ১১ হাজার ৮৫৩ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদরে ৮২৫ হেক্টর, কলারোয়ায় ৩ হাজার ৮৫৫, তালায় ৩ হাজার ৫৫, দেবহাটায় ৬০, কালীগঞ্জে ২৫, আশাশুনিতে ৯৫ এবং শ্যামনগর উপজেলায় ৪ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১হাজার হেক্টর বেশি আবাদ হয়েছে।
সূত্রটি আরো জানায়, গত মৌসুমে জেলায় পাটের আবাদ হয়েছিল ১২ হাজার ৮২০ হেক্টর। জেলায় এবার দেড় লাখ বেল্ট পাট উৎপাদন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম জানান, পাট একটি লাভজনক ফসল। তাছাড়া জেলার মাটি ও আবহাওয়ার কারণে ভালো উৎপাদনও সম্ভব। কিন্তু পাট রফতানি চাহিদা যদি ভালো না হয় তাহলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবেন কীভাবে? তারপরও লোকসান হওয়ার মতো ফসল এটি না। কিন্তু এবার চাষীদের খরচ একটু বেশি হয়েছে। তার কারণ হলো সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় সেচ দিতে হয়েছে। তারা বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে পাট পচায়। এতে করে শ্রমিক বা পরিবহন খরচ বাড়তি লেগেছে।