সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও তৎপরবর্তী পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের সীমান্তবর্তী এলাকায় আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে মাদক চোরাকারবারী ও মানব পাচারকারী চক্র। এ অঞ্চলের সুন্দরবন ও নৌপথ ব্যবহার করে চোরাকারবারী ও পাচারকারী চক্র বাড়তি সুবিধা ভোগ করছে বলেও জানা গেছে।
সাম্প্রতি বেশ কয়েকটি অভিযানে সীমান্ত এলাকা থেকে মাদকসহ ভারতীয় অবৈধ মালামাল উদ্ধার হয়। এছাড়াও পাচারকারী চক্রের আস্তানা থেকে পাচার হওয়ার আগে নারী-পুরুষ উদ্ধার করা গেলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে পাচার চক্রের মূল হোতারা। বলা যায়, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ডসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার নানামুখী অভিযানের পরও বন্ধ হচ্ছে না মাদক ও মানব পাচার। প্রশাসন ম্যানেজসহ নানা কৌশলে এসব অপরাধ চলছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। আর এভাবে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জনপদের এ অংশটি এখন চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে।
স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে ও গোয়েন্দা সূত্রমতে, উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে মাদক চোরাকারবারী ও মানব পাচারকারী চক্র। এই চক্রের সঙ্গে আত্মসমর্পণকৃত বনদস্যু ও জেল পলাতক আসামিদের যোগসাজশে অপহরণ, মুক্তিপণ, মাদক ও অবৈধ ভারতীয় মালামাল চোরাকারবারী এবং মানব পাচারের সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্ক রয়েছে বলে জানা গেছে।
সূত্র মতে, শ্যামনগরের কৈখালী, নুরনগর, রমজাননগর, মুন্সিগঞ্জসহ উপকূলের সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার বেশ কয়েক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় তারা এই অপকর্ম করছে। তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহাজনি প্রথার মাধ্যমে ভারতীয় অবৈধ মালামাল, মাদক ও ভারতীয় ঔষধ সামগ্রী অবৈধ পথে ভারত থেকে এনে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করে। এছাড়াও রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে শিশু, নারী ও পুরুষ পাচার করাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নারীদেরকে পাচারের উদ্দেশ্যে এনে পাশবিক নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ রয়েছে, সুন্দরবন সংলগ্ন সীমান্তপথে চোরাচালানের বিষয়টি জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের কাছে ‘ওপেন সিক্রেট’। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাঠ পর্যায়ে কর্মরতদের অনেকেই বিষয়টি জানেন। তারপরও নিয়ন্ত্রণ দূরের কথা অজ্ঞাত কারণে দিনে দিনে তা বেড়েই চলেছে। চোরাচালান পণ্যের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে মাঝে মধ্যেই সংঘর্ষ বাঁধছে চোরাকারবারীদের অপরাপর গ্রুপের মধ্যে। সুন্দরবন সংলগ্ন সীমান্তবর্তী কৈখালী, গোলাখালী, কালিঞ্চি, ভেড়ার মোড়, পরানপুর, নৈকাটিসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার স্থানীয়দের পাশাপাশি চোরাকারবারির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সীমান্ত সংলগ্ন কয়েকটি অংশকে নিরাপদ রুট (যাত্রাপথ) হিসেবে বেছে নিয়েছে চোরাকারবারিরা। এর মধ্যে সীমান্তবর্তী কালিন্দি ও রায়মঙ্গল নদী পথে চোরাচালানের সুযোগ বেশি এবং ঝুঁকিও কম হওয়ায় কারবারিরা চোরাচালানের ‘মূল পয়েন্ট’ হিসেবে বেছে নিয়েছে এই এলাকাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চোরাচালানের কাজে অংশ নেয়া কয়েকজন শ্রমিক জানান, ভারতীয় চোরাকারবারিরা গরু ও মাদকের চালান কচুখালী, বকচরা, তালপট্টি ও হোগলডুরি এলাকায় রেখে যায়। বড় চালান রায়মঙ্গল এবং ছোট চালান কালিন্দি নদী সংলগ্ন পাঁচ নদীর মোহনা দিয়ে সুন্দরবনে ঢুকে যায়। স্থানীয় চোরাচালান চক্রের সদস্যরা মাছ বা কাঁকড়া শিকারের অজুহাতে স্পট থেকে সেই চালান সংগ্রহ করে। সুবিধাজনক সময়ে সেগুলো কৈখালী ও ভেটখালী স্লুইসগেট, গোলাখালী, কালিঞ্চি এবং পশ্চিম কৈখালী বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকা দিয়ে পাচার করে। এর আগে ভারতের শমসেরনগর, কালিতলা, ঘুমটে ও গোবন্দকাঠি থেকে মাদকের বস্তা, ঔষধের কার্টুন, অবৈধ ভারতীয় মোবাইল এবং বিভিন্ন পণ্যসহ গরু নৌকায় উঠিয়ে দেওয়া হয়।
তারা আরও জানান, কৈখালীর পাঁচ নদীর মোহনা থেকে কিছুটা দূরত্বে বনবিভাগের কৈখালী স্টেশন, রায়নগর নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি ও কৈখালী বিজিবি ক্যাম্প। এই অংশ দিয়ে চোরাচালানে ঝুঁকি রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগসাজশ করেই তারা চোরাচালানের কাজ করছেন। এ কাজ নির্বিঘ্ন করতে তারা তাদের সাথে চুক্তির মাধ্যমে এসব অপকর্ম করছেন বলেও জানেনা।
জানা যায়, সুযোগ বুঝে চোরাকারবারীর কাজের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা শব্দবিহীন দ্রুতগামী ট্রলারে করে এসব অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে সীমান্তর কয়েকটি চোরাকারবারী গ্রুপ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মানব পাচারের জন্য ব্যবহার করা হয় সীমান্তবর্তী নূরনগরের কুলতলী, দুরমুজখালী, কৈখালীর নৈকাটি,পরানপুরসহ রোহিঙ্গা নারী পাচারের হটস্পট খ্যাত সীমান্তবর্তী সুন্দরবন সংলগ্ন সুন্দরবন লাগোয়া কালিঞ্চির গোলাখালী এলাকাকে। এসব এলাকা দিয়ে নৌপথে ভারতে লোক পাচার করা হচ্ছে হরহামেশাই।
এছাড়াও অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সাম্প্রতি ভারতে রসুন ও সুপারির দাম বৃদ্ধি থাকায় বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে যাচ্ছে রসুন ও সুপারি অন্যদিকে ভারত থেকে আসছে মাদক, গরু ও ক্যান্সার প্রতিরোধক কেমোসহ ভারতীয় বিভিন্ন অবৈধ পণ্য। এছাড়াও অতি সাম্প্রতি ভারতীয় আরও এক ধরনের ট্যাবলেট আসছে বাংলাদেশে যা নেশা জাতীয় ও যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে রিভারাইন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (আরবিজিবি) কৈখালী ক্যাম্পের একজন কমান্ডার বলেন, এমন অনৈতিক কাজের সঙ্গে বিজিবির কোনো সদস্য জড়িত আছে এমন অভিযোগ এখন পর্যন্ত কেউ করেনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রায়নগর নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মঞ্জুরুল আলম বলেন, আমি এখানে একবারে নতুন এসেছি মাত্র কয়েকদিন হলো। চোরাকারবারিরা কোন রুট ব্যবহার করতেছে আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারলে আমার সুবিধা হয় অভিযান পরিচালনা করতে। তবে অনুসন্ধানে উঠে আসা কয়েকটি রুটের নাম উল্লেখ করে বলা হলে ওইসব স্থানগুলাতে নৌ-পুলিশের টহল জোরদার করা হবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. মশিউর রহমান বলেন, জনবল সংকট থাকায় সব সময় অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। তবে খুব শীঘ্রই বন বিভাগ, নৌ-পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ডের যৌথ অভিযান সুন্দরবনের পরিচালিত হবে বলে জানান এই কর্মকার।
শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হুমায়ুন কবির মোল্লা বলেন, সীমান্ত এলাকা নজরদারির জন্য বিজিবি, নৌ-পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী কাজ করছে। তাছাড়া মাদকের বিরুদ্ধে থানা পুলিশের পক্ষ থেকে টহল জোরদার করে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।