খুলনা ব্যুরো : পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ও কেএমপির সাবেক কমিশনার মোজাম্মেল হকসহ ১৯ জনের নামে আদালতে মামলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক (খালিশপুর আমলি) আদালতে এ মামলাটি করেন আনিছা সিদ্দিকা। ওই আদালতের বিচারক ম্যাজিস্ট্রেট আল আমিন আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে মামলাটি রুজু ও তদন্তের জন্য খালিশপুর থানা পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। আনিসা সিদ্দিকার স্বামী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক আলমগীর শিকদার। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন বাদীপক্ষের আইনজীবী শফিকুল ইসলাম লিটন।
মাওলানা সাঈদীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আমেরিকায় মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি গবেষক তানজিলুর রহমানের ফেসবুক স্ট্যাটাসের জের ধরে বড় বয়রাস্থ হাজী ফয়েজ উদ্দিন রোডের বাড়ি থেকে অন্তর্ঘাতমূলক ষড়যন্ত্র করার অপরাধে মা আনিছা সিদ্দিকাকে গ্রেফতারের ঘটনায় এ মামলাটি হয়েছে।
এ মামলায় পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, কেএমপি সাবেক কমিশনার মোজাম্মেল হক, সহকারী পুলিশ কমিশনার গোপিনাথ কাঞ্জিলাল, তৎকালীন খালিশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (বর্তমানে সদরের ওসি) শেখ মুনীর উল গিয়াস, উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. গোলাম মোস্তফা, এসআই রেজোওয়ান উজ্জামান, এসআই এসকেএম শরিফুল ইসলাম, এসআই সাগর হালদার, এসআই সঞ্জিত কুমার মন্ডল, এসআই মো. রফিকুল ইসলাম, এসআই মো. রাকিবুল ইসলাম, এএসআই শেখ নুরুজ্জামান, এএসআই আরিফুজ্জামান, কনস্টেবল তানজিন আক্তার, কনস্টেবল সাজ্জাদুল ইসলাম, কনস্টেবল কামরুন্নেছা হ্যাপিকে আসামি করা হয়েছে।
বয়রা আবাসিক এলাকার মৃত ফজলুল হকের ছেলে মহানগর যুবলীগের সদস্য মো. ইয়াসিন আরাফাত, হাজী ফয়েজ উদ্দিন রোডের মৃত আব্দুল গফ্ফারের দু’ ছেলে সৈয়দ নাহিদুজ্জামান ও নজিরুজ্জামানসহ অজ্ঞাত আরও ১০-১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলা সূত্রে জানা যায়, জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট আমেরিকার মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির ম্যাটেরিয়াল সাইন্সের পিএইচডি গবেষক তানজিলুর রহমানের ঞধহুরষ উ গবঃধষষরংঃ নামে ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন ‘আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার সাক্ষী সুখরঞ্জন বালির ভূমিকা আমার কাছে ইতিহাসের বিরল ঘটনা বলে মনে হয়। তাকে আমি কোনো ছকেই ফেলতে বা বুঝতে পারি না। তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় ব্যাপারটা আরও অদ্ভুত। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে প্রথমে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড দেয় এবং পরে হাইকোর্ট যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন সুখরঞ্জন বালির ভাই বিসা বালির হত্যাকান্ডে। এই মামলার রায় সঠিক হয়নি বলে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে সুখরঞ্জন বালি আদালতে সাক্ষী দিতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে অপহৃত হয়। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন ভারতের কারাগরে আটক ছিলেন। বিবেকের তাড়নায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জানাজায় উপস্থিত হয়ে আইন বিচার এবং পুলিশের কর্মকান্ড মিডিয়ার কাছে তুলে ধরেন।’ এই স্ট্যাটাস দেয়ার একদিন পরই তানজিলুর রহমানের মা আনিছা সিদ্দিকাকে খুলনার খালিশপুর থানার বয়রা হাজী ফয়েজ উদ্দিন সড়কের মামা বাড়ি থেকে ২০ আগস্ট গ্রেফতার করে পুলিশ।
ওইদিনের অপর একটি স্ট্যাটাসে তানজিলুর রহমান উল্লেখ করেন-‘সাঈদী সাহেবের জানাজায় সুখরঞ্জন বালির উপস্থিতি নিয়ে আমার লেখাটা অনেক জায়গা থেকে শেয়ার হওয়ায় ২০২৩ সালের ২০ আগস্ট রোববার খুলনার বয়রা এলাকার হাজী ফয়েজ উদ্দিন সড়কে আমার নানাবাড়িতে স্থানীয় যুবলীগ নেতারা পুলিশ নিয়ে হাজির হয়ে তান্ডব চালায় ও লুটপাট করে। দুইটা ল্যাপটপ ও নগদ টাকা নিয়ে যায়। আমার ছোট মামা সিদ্দিক শহীদকে বেদম মারধর করে। আমার মা আনিছা সিদ্দিকা এগুলো সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদ জানানোয় তাকে খালিশপুর থানায় ধরে নিয়ে গেছে। দুইজন ভাড়াটিয়া এগিয়ে আসায় তাদেরকেও সঙ্গে নিয়ে গেছে। জি হুজুর শুনে অভ্যস্ত পুলিশ প্রতিবাদের কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে আমার মা’কে সারারাত থানাহাজতে আটকে রেখে গোপন বৈঠকের অভিযোগে মামলা দিয়ে কোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছে।’
স্ট্যাটাস দেওয়ার পর ২০২৩ সালের ২০ আগস্ট দুপুরে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার মোজাম্মেল হক, সাবেক সহকারী পুলিশ কমিশনার গোপিনাথ কাঞ্জিলাল ও খালিশপুর থানার তৎকালীন ওসি মুনীর উল গিয়াসের নেতৃত্বে ১৬ জন পুলিশ কর্মকর্তাসহ স্থানীয় তিনজন ও আরও ১০-১৫ জন খালিশপুর থানাধীন ৫/১ বয়রা হাজী ফয়েজ উদ্দিন রোডে বাদীর বাবার বাড়িতে অনধিকার প্রবেশ করেন। তারা ওই বাড়ির তৃতীয় তলায় ঘরের দরজা খোলার জন্য অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। এমনকি তারা গুলি করার হুমকিও দিতে থাকেন। এরপর আনিছা ছিদ্দিকা দরজা খুলে দেন। দরজা খুলতে দেরি হওয়ার কারণে ওসি মুনীর উল গিয়াস তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। তখন তাকে সহকারী পুলিশ কমিশনার ও ওসি তার ছেলের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেন। তাকে বলা হয় ‘যুক্তরাষ্ট্রে বসে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রপাগান্ডা ছাড়িয়ে সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা ও জনগণকে উত্তেজিত করছে।’
তখন আনিছা সিদ্দিকা বলেন, এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। এ কথা শোনামাত্র আসামিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ঘরের মালামাল ভাঙচুর ও তছনছ করতে থাকেন। তারা ঘর থেকে তিনটি ল্যাপটপ, যার আনুমানিক মূল্য দেড় লাখ টাকা এবং চারটি মোবাইল ফোন নিয়ে যান। এরপর তারা বাড়ি দ্বিতীয় তলায় ভাঙচুর এবং নিচতলায় অবস্থানরত ব্যাচেলরদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। এ ঘটনার প্রতিবাদ করলে আনিছা সিদ্দিকা, মো. রকিবুল ইসলাম ও মোঃ তামিম ইকবালকে গ্রেফতার করে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়। সেইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে খালিশপুর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫(৩)/২৫ ডি ধারায় মামলা দেওয়া হয়।
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, আসামিরা খালিশপুর থানায় মিথ্যা মামলা করায় দেশসহ সমগ্র পৃথিবীতে তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়ে।
ফেসবুক স্ট্যাটাসের জের ধরে ২০ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে বড় বয়রাস্থ হাজী ফয়েজ উদ্দিন বাড়িতে অভিযান চালায় খালিশপুর থানা পুলিশ। এসময় অন্তর্ঘাতমূলক ষড়যন্ত্র করার জন্য সমবেত হওয়ার অভিযোগে মো. রকিবুল ইসলাম (২৪), মো. তামিম ইকবাল (১৯) এবং আনিছা সিদ্দিকা (৪৫) কে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পুলিশ। তাদের হেফাজত থেকে বিপুল পরিমাণ ধর্মীয় উগ্রপন্থি বিভিন্ন বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিন, রেজিস্টার, লিফলেট এবং অন্তর্ঘাতমূলক ষড়যন্ত্র করার কাজে ব্যবহৃত ৩টি ল্যাপটপ, পাসপোর্ট এবং ৪টি মোবাইল ফোন উদ্ধার দেখিয়ে তাদের বিরুদ্ধে খালিশপুর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলায় দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হয় আনিসা সিদ্দিকাকে। এঘটনায় উপরোক্ত আসামিদের বিরুদ্ধে আনিসা সিদ্দিকা বাদী হয়ে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নালিশী পিটিশন দাখিল করেছেন (নং- সিআর ৫৬৪/২৪)।