এসএম শহীদুল ইসলাম, সাতক্ষীরা : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুপেয় পানির আধার এখন ধুঁকছে। লবণাক্ততার প্রভাব পড়েছে উপকূলজুড়ে। সুপেয় পানির সঙ্কটে ভুগছে উপকূলের শিশুসহ সব বয়সের মানুষ। বৃষ্টিপাতের অস্বাভাবিকতা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলের মানুষ দিশেহারা।
উপকূলে সুপেয় পানির উৎসগুলো দিন দিন লবণাক্ত হয়ে উঠছে। উপকূলজুড়ে সুপেয় পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কোনো না কোনোভাবে লবণাক্ত পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছে এ জনপদের মানুষ। লবণপানি পান করার কারণে শিশুরা নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। লবণাক্ততা ফসল উৎপাদনেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
গবেষকরা বলছেন, সাতক্ষীরা ও খুলনার কিছু কিছু এলাকায় পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ১০ পিপিটি (লবণাক্ততা পরিমাপক মাত্রা) পর্যন্ত। এক এলাকার লবণাক্ততা আশপাশের অন্য এলাকায় মাটির ওপরও প্রভাব বিস্তার করছে।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, উপকূলের ৩ শতাংশ শিশু মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে মারা যায়। লবণাক্ততার প্রভাব উপকূলের কৃষি, অর্থনীতি ও জীবন-জীবিকার ওপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে।
লবণাক্ততাসহ জলবায়ুগত বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে উপকূলের মানুষ এলাকা ছাড়ছে। উদ্বাস্তু শিশুরা উপকূল ছেড়ে অন্য স্থানে গেলেও সেখানেও যে বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে সে নিশ্চয়তা নেই। উপকূলের অধিকাংশ গ্রামে বিশুদ্ধ পানির একমাত্র ভরসা ‘গভীর নলকূপ’। গভীর নলকূপ বসিয়ে ভূগর্ভ থেকে প্রতিদিন একেকটি গ্রাম পর্যায়ে হাজার হাজার লিটার পানি ওঠানো হচ্ছে। উপকূলের হাজার হাজার গ্রামের প্রায় সব পরিবারে এখন টাকা দিয়ে বিশুদ্ধ পানি কিনতে হচ্ছে। যেসব পরিবার বিশুদ্ধ পানির জন্য অর্থ ব্যয় করছে তাদের হয়তো কোনো সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না। কিন্তু যেসব পরিবার বিশুদ্ধ পানি কিনছে না তাদের লবণপানি পান করে জীবন চালাতে হচ্ছে। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করা শিশুদের অধিকাংশই লবণপানি পান করছে এবং কোনো না কোনোভাবে পান করতে বাধ্য হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকার শিশুরা স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। উপকূলের শিশুদের এগিয়ে যাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা লবণাক্ততা।
চারিদিকে পানি থৈ থৈ করছে অথচ খাবার পানি নেই। উপকূলজুড়ে দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। সুপেয় পানির সংকট নিরসনের দাবিতে খালি কলস মাটিতে উপুড় করে দিয়ে ‘লবণ জলে, জীবন জ্বলে’ শীর্ষক মানববন্ধনও করেছেন স্থানীয় নারীরা। ০৮ জুন ২০২৪ রোজ শনিবার বিকালে উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের মথুরাপুর গ্রামের জেলেপাড়ায় পার্টিসিপেটারি রিসার্চ আ্যান্ড আ্যাকশন নেটওয়ার্ক (প্রাণ) ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এ্যাকশন এইডের সহযোগিতায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘শরুব ইয়ুথ টিম’ বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে ওই মানববন্ধনের আয়োজন করে। মানববন্ধনে শরুব ইয়ুথ টিমের নির্বাহী পরিচালক এস এম জান্নাতুল নাঈম বলেন, উপকূলীয় জেলাগুলোতে অঞ্চলভিত্তিক পানি সংকটের ধরন চিহ্নিত করে সুপেয় পানিতে সর্বজনীন ন্যায্য ও টেকসই প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে সরকারি বরাদ্দ এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। পানি পরিসেবাকে আরো সাশ্রয়ী করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
শরুবের সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা উপকূলজুড়ে সুপেয় পানি সংকটের কথা তুলে ধরে বলেন, চারিদিকে শুধু পানি, নেই শুধু সুপেয় পানি। বার বার নদী ভাঙনের ফলে উপকূলের মিষ্টি পানির আধারগুলো লবণ পানিতে ডুবে যায়। খাওয়ার পানি সংগ্রহে উপকূলের নারীদের সবসময় সংগ্রাম করতে হয়। বাধ্য হয়ে পানি কিনে খেতে হয়। এর সমাধান হওয়া দরকার।
উপকূল কন্যা তনুশ্রী মন্ডল বলেন, উপকূলীয় এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এলাকাভিত্তিক বড় বড় পুকুর, খাল, জলাশয় খনন করে তাতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি পুকুরের ইজারা বাতিল করে সকলের জন্য সুপেয় পানি ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হবে।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন, জলবায়ু যোদ্ধা ও শরুব ইয়ুথ টিমের মুন্সিগঞ্জ ইউনিটের কো-ফ্যাসিলেটর বিশ্বজিত মন্ডল, বুড়িগোয়ালিনী ইউনিটের হৈমি মন্ডল, বিক্রম মণ্ডল, ঈশ্বরীপুর ইউনিটের আব্দুস সালাম, স্বপ্না পারভীন, সবুজ মন্ডল, আকাশ সানা, রুপালী খাতুন প্রমুখ।